ঢাকা বৃহস্পতিবার
২১ নভেম্বর ২০২৪
২৯ অক্টোবর ২০২৪

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ


ডেস্ক রিপোর্ট
171

প্রকাশিত: ০৭ মার্চ ২০২৪ | ০৩:০৩:৪০ পিএম
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ ফাইল-ফটো



আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ও ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তিনি এ আগুনঝরা ভাষণ দেন। শোষিত বঞ্চিত মানুষের মনের অব্যক্ত কথা যেন বের হয়ে আসে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি উচ্চারণে, প্রতিটি বর্ণে ও শব্দে। তার প্রতিটি উচ্চারণ ধ্বনিত- প্রতিধ্বনিত হতে থাকে লাখো প্রাণে। গগনবিদারী আওয়াজ তুলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমর্থন জানায় উপস্থিত লাখো জনতা। ঐতিহাসিক ওই ভাষণ এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পরিগণিত।

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজির হন বাঙালি জাতির স্বপ্নপূরণের দিশারি হয়ে এবং ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা ছিল মূলত বাঙালি জাতির বুকে তীব্র ক্ষোভে লালন করা এক শিখা। যেখানে তিনি বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা ও অবহেলা থেকে মুক্তির ধারাবাহিক আন্দোলনের চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বলেন,
“রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। 
এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জয় বাংলা।”

ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আরোহণ করেন বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে। ফাগুনের সূর্য তখনো আলো ছড়াচ্ছিল। মঞ্চে আসার পর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাখ লাখ বাঙালির ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। তিনি দরাজ গলায় তার ভাষণ শুরু করেন- ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি’ এরপর জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার মহাকাব্যের কবি ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম..., এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণ। এই স্বল্প সময়ে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন। তিনি তার ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া এবং বিভিন্ন স্থানের হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। আজও আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’ তিনি বলেন, ‘আমি বলে দিতে চাই- আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সর্বশেষ দু’টি বাক্য, যা পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিকনির্দেশনা ও প্রেরণার হাতিয়ারে পরিণত হয়। 

শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পুরো জীবন কাজ করে গেছেন দেশ ও জাতির কল্যাণে। তাঁকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেন,
“আমি হিমালয় দেখিনি। 
তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি।
ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। 
এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করলাম।”

এই কারণেই তাঁর ৭ মার্চের ভাষণটি বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (Memory of the World International Register) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণসহ মোট ৭৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একই সঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংরক্ষণ করে থাকে। মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডাব্লিউ) ৭ মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে।

বাঙালি জাতিকে অত্যাচার, নির্যাতন ও বন্দিত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে ৭ মার্চের ভাষণ পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সবাইকে আত্মোৎসর্গের জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইতিহাসের ঝোড়ো হাওয়া যখন একটি জাতির ভাগ্য অনিবার্যভাবে ভেঙে চুরমার করে দিতে থাকে তখন তাদের ভাগ্য রক্ষার দিশারি হয়ে বাংলার মানুষের পাশে আবির্ভাব হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এক হাতে ‘মৃত্যু’ আরেক হাতে ‘মুক্তির বার্তা’ নিয়ে যিনি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিলেন বাংলার মানুষের মুক্তির দূত হয়ে এবং মৃত্যুর ভয়কে জয় করে তিনি পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাই বলাই বাহুল্য, ৭ মার্চের ভাষণই প্রকৃত অর্থে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।

বঙ্গবন্ধুর এই বজ্র-নিনাদে আসন্ন মহামুক্তির আনন্দে বাঙালি জাতি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষ্যে।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সে ভাষণ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে পড়ে। মূলত বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে উদাত্ত আহ্বানেই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে বাঙালি। পরে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো।


আরও পড়ুন:

বিষয়: