ঢাকা শুক্রবার
২৯ মার্চ ২০২৪
২৬ মার্চ ২০২৪

সোনায় মোড়ানো’ কপাল তাঁদের, মামলা হলেও বিচার শেষ হয় না


ডেস্ক রিপোর্ট
201

প্রকাশিত: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০৪:০২:১৮ পিএম
সোনায় মোড়ানো’ কপাল তাঁদের, মামলা হলেও বিচার শেষ হয় না ফাইল-ফটো



২০১৩ সালের ২৪ জুলাই। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজের কার্গো হোল্ড থেকে ১২৪ কেজি সোনা জব্দ করেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। তদন্ত শেষে সে বছর বিমানের ১০ কর্মীসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। এটা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জব্দ সবচেয়ে বড় সোনার চালান। ডিবি সে বছর অভিযোগপত্র দিলেও ১০ বছরে এ মামলার বিচার শেষ হয়নি।

পরের বছর বিমান বাংলাদেশের একটি উড়োজাহাজের টয়লেটে বিশেষভাবে লুকিয়ে রাখা ১০৬ কেজি সোনা জব্দ করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। এটা ছিল শাহজালাল বিমানবন্দরে জব্দ হওয়া দ্বিতীয় বৃহৎ সোনার চালান। এ ঘটনায় হওয়া মামলা তদন্তে পুলিশের তিন সংস্থার কেটে যায় আট বছর। গত বছর আদালতে ৪৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হলেও এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি। শুধু এ দুটি নয়, সোনা চোরাচালানের আলোচিত এমন অন্তত ৫০টি মামলা ঢাকার আদালতে বিচার শুরুর অপেক্ষায় আছে।

এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তাপস কুমার পালের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কিছু মামলায় অনেকেই আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেন না। এ ছাড়া পরিত্যক্ত সোনা উদ্ধারের ঘটনায় কাউকে অভিযোগপত্রভুক্ত না করায়, তা অধিকতর তদন্তের জন্য একাধিকবার তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠানো হলে তারা তদন্ত প্রতিবেদন পাঠাতে দেরি করে। এসব কারণেই মূলত মামলার বিচারে দেরি হচ্ছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ১০ বছরে (২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত) অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করেন। জব্দ হওয়া সোনার বাজারমূল্য প্রায় ১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এসব ঘটনায় হওয়া মামলায় ২৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগরে ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সোনা জব্দের ঘটনায় হওয়া ১৮৭টি মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ৭৪টি, ২০২০ সালে ৩৯টি এবং ২০২১ সালে ৭৪টি মামলা হয়।

পুলিশ ও আদালত সূত্র জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল বিমানের উড়োজাহাজের টয়লেট থেকে ১০৬ কেজি সোনা জব্দের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়। এই মামলার তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি বিমানের ১০ জন কর্মীসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি। তবে আদালত অভিযোগপত্রে সন্তুষ্ট না হয়ে মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেয়।

পিবিআই দুই বছরের তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিলে আদালত আবার অধিকতর তদন্তের জন্য মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠান। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি সিআইডি বিমানের ১৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। এরও দুই বছর পর গত বছরের ২৮ জুন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। তবে মামলার সাক্ষীদের এখনো আদালতে হাজির করেনি রাষ্ট্রপক্ষ।

আর ২০১৩ সালে নেপালের কাঠমান্ডু থেকে আসা বিমানের ফ্লাইটে ১২৪ কেজি সোনা জব্দের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। ডিবি ২০১৭ সালের ২ মার্চ বিমান বাংলাদেশের ৭ কর্মীসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এদের মধ্যে সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী মিলন শিকদার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওই মামলার বিচারকাজ শুরু হলেও গত ছয় বছরে তা শেষ হয়নি।

এদিকে ২০১৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনের একটি বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটে অভিযান চালান শুল্ক গোয়েন্দারা। সেখান থেকে দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও ৬১ কেজির ৫২৮টি সোনার বার জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ফ্ল্যাটমালিক এস কে মোহাম্মদ আলীকে (৫০)। তিনি একটি সোনা চোরাচালান চক্রের হোতা বলে জানানো হয়। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার তৎকালীন চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা রিয়াজউদ্দিনকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সোনা উদ্ধারের তিন বছর পর ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি মোহাম্মদ আলী, রিয়াজউদ্দিনসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি। গত ছয় বছরেও ওই মামলার বিচার শেষ হয়নি। এর মধ্যে মোহাম্মদ আলী, রিয়াজউদ্দিনসহ গ্রেপ্তার তিনজন জামিনে মুক্ত হয়েছেন। বাকি ৯ আসামিই পলাতক।

মামলার বাদী তৎকালীন শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান এখন ঢাকার আগারগাঁওয়ে কর্মরত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ১০ বছর আগে মামলাটি করেন। আদালতে এখনো মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। কয়েক দিন আগে মামলার বাদী হিসেবে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি।  

সোনা চোরাচালানসংক্রান্ত মামলাগুলো নিয়ে আদালতের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আলোচিত মামলাগুলোর সব আসামিই এখন জামিনে মুক্ত।

সোনা চোরাচালানের আলোচিত কয়েকটি মামলার তদন্ত তদারকে যুক্ত ছিলেন ডিবির সাবেক উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম। তিনি এখন সিআইডির উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি)। নাজমুল আলম গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ডিবিতে থাকার সময় সোনা চোরাচালান চক্রের নেতৃত্বদাতাদের বেশির ভাগকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের প্রায় সবাই জামিনে বেরিয়ে আবার সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। এ কারণে সোনা চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না।

উদাহরণ দিয়ে শেখ নাজমুল আলম বলেন, হুন্ডি ব্যবসায়ী সালেহ আহম্মেদ ও সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত নজরুল ইসলামকে তিনি গ্রেপ্তার করেছিলেন। কিন্তু পরে তাঁরা জামিনে মুক্ত হয়ে দুবাইয়ে চলে যান। দুবাই থেকেই তাঁরা আবারও বাংলাদেশে সোনা চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত হন।

দায়সারা তদন্ত, বাহক ছাড়া অন্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরে
গত ১০ বছরের সোনা চোরাচালান মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ মামলা তদন্ত করে বিমানবন্দর থানা-পুলিশ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে সোনা চোরাচালানে জড়িত সংঘবদ্ধ চক্রগুলোর কার্যক্রম, জব্দ সোনার প্রকৃত মালিক, কার কাছে সোনা পৌঁছানোর কথা, এর পেছনের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা কারা—সেসব নিয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য থাকে না। বেশির ভাগ অভিযোগপত্রের ভাষা প্রায় একই ধরনের। অভিযোগপত্রে সোনা বহন করার সময় আটক ব্যক্তি ছাড়া কাউকে আসামি করা হয়নি। আবার কোনো মামলায় সোনা চোরাচালানে জড়িত কারও নাম উল্লেখ না করেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে ৬৯৯ গ্রাম সোনাসহ আটক হন কাউছার হামিদ (২৬)। তিন মাস তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্রে কাউছারকে চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই চক্রের অন্য সদস্য কারা বা চক্রের হোতা কে, সে সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি অভিযোগপত্রে।

আবার তদন্তে সন্দেহভাজন কারও নাম পাওয়া গেলেও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা জানা সম্ভব হয়নি জানিয়ে সন্দেহভাজনদের নাম ছাড়া অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার ঘটনাও আছে।

২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও চলাচল কর্তৃপক্ষের কর্মচারী সাইফুল ইসলাম দেওয়ানসহ (৩০) তিনজনকে ১১ কেজি ৩০০ গ্রাম সোনাসহ আটক করা হয়। পরদিন বিমানবন্দর থানায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তদন্তে এই তিনজন ছাড়া আরও দুজনের নাম সন্দেহভাজন হিসেবে পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ নাম ঠিকানা উদ্ধারে ব্যর্থ হওয়ার কথা জানিয়ে সন্দেহভাজনদের বাদ দিয়েই আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এতে সোনা বহনকারী ছাড়া চোরাচালান চক্রের অন্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যায়।

২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি মালয়েশিয়া থেকে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করা মালিন্দো এয়ারের ফ্লাইটের চারটি সিটের পেছনে লুকিয়ে রাখা ৩২ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ঢাকা কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষ মামলা করে। আলোচিত এই সোনা চোরাচালানের মামলা তদন্তের দায়িত্ব থানা-পুলিশের হাত ঘুরে যায় সিআইডির কাছে।

প্রায় তিন বছর তদন্ত করেও এর সঙ্গে জড়িত কাউকে চিহ্নত করতে পারেনি সিআইডি। সিআইডি চোরাচালানে জড়িত সন্দেহে নয়জনকে গ্রেপ্তার করে। তবে এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ না পেয়ে তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে পিবিআইকে মামলা তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। এই সংস্থাটিও কাউকে খুঁজে বের করতে না পেরে গত বছর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়।

আইনজীবীরা বলছেন, বিমানবন্দর থানা-পুলিশের তদন্ত দায়সারা গোছের। এ কারণে প্রকৃত সোনা চোরাচালান চক্রের হোতাদের বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ১০ বছর আগের তদন্তের সঙ্গে গত দুই বছর ধরে করা সোনা চোরাচালানের মামলার তদন্তে কোনো মিল নেই। তিনি দাবি করেন, এখন পুলিশ দায়সারা তদন্ত করে না, জব্দ হওয়া সোনার প্রকৃত মালিক, এর নেপথ্যের ব্যক্তি, কোথা থেকে এসেছে, কার কাছে যাবে—সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য বের করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।  

পুলিশ কর্মকর্তা আজিজুল হকের দাবি, শুধু পরিত্যক্ত অবস্থায় সোনা জব্দ হলে সে ক্ষেত্রে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। কারও কাছ থেকে সোনা উদ্ধার হলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয় না।

সোনা চোরাচালানের মামলার বিচারেরর দূর্ঘসূত্রতার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাক্ষীও অনেক ক্ষেত্রে দেশের দূরবর্তী স্থান চলে যান। তারা সময়মতো আদালতে সাক্ষ্য দিতে না পারায় বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের আদালতগুলোর বিচারকেরও সংকট আছে। এ ব্যাপারে সরকারেরও কোনো সদিচ্ছা নেই।


আরও পড়ুন: